প্রশ্ন:-
জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড কি? এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ভারতে কি প্রতিক্রিয়া ছিল?
অথবা,
জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের প্রেক্ষাপট কি ছিল? এই ঘটনার গুরুত্ব আলোচনা করো।
ভূমিকা→ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত দমনমূলক রাওলাট আইন কে কেন্দ্র করে গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষ সর্বত্র রাওলাট সত্যাগ্রহ আন্দোলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ইতিহাসে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে। এই আন্দোলন পাঞ্জাবে ব্যাপক আকার ধারণ করে। তাই ব্রিটিশ সরকার এই আন্দোলন দমন করতে অনেক বেশি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দেন। এই প্রসঙ্গে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বলেছেন "এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ভারতের মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়" তা উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এবং সবার হৃদয় আন্দোলিত করে।
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট→
অত্যাচারে তীব্রতা বৃদ্ধি→ পাঞ্জাবের মুখ্য প্রশাসক গভর্নর মাইকেল ও ডায়ার অত্যাচারী শাসন পাঞ্জাবকে বারুদের স্তূপে পরিণত করে। জুলুম চালিয়ে যুদ্ধের জন্য পাঞ্জাব থেকে সেনা ও অর্থ সংগ্রহ করে এবং পাঞ্জাবের উপর চরম নির্যাতন চালায়। ফলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের মানুষ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে যায়।
রাওলাট আইনের প্রয়োগ→ সরকার ভারতীয়দের যাবতীয় স্বাধীনতার অধিকার কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে দমনমূলক রাওলাট আইন প্রবর্তনের করলে দেশবাসী ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মার্চ মাসে থেকে এই বিপ্লব পাঞ্জাবে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
নেতৃত্ববৃন্দদের গ্রেপ্তার→ পিপুলস কমেটি নামে এক গণসংগঠন লাহোর ও অম্রিতসরের রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ফলে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ১০ এপ্রিল সৈফুদ্দিন কিচলু ও ডক্টর সত্যপাল কে গ্রেপ্তার করলে জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে গান্ধীজিকে গ্রেফতার খবর ছড়িয়ে পড়লে লাহোর ধর্মঘট পালিত হয়। তারপর উত্তেজিত জনতা বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালত ও টেলিফোন লাইন এবং ইউরোপীয় নারী-পুরুষের ওপর আক্রমণ চালায়।
অমৃতসরের সামরিক শাসন জারি→ অমৃতসরের আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে পাঞ্জাবের শাসনভার তুলে দেওয়া হয়। সামরিক আইন করে ১১ এপ্রিল জনসভা ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের বিবরণ→ ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ১৩ এপ্রিল জালিয়ান ওয়ালাবাগে প্রায় ১০ হাজার জনতা সমবেত হয়েছিল। সভাস্থল টির চারিদিকে ছিল বড় বড় পাকা বাড়ি এবং প্রাচীর দিয়ে গেরা। পাঞ্জাবের শাসনকর্তা মাইকেল ও ডায়ার সেনাবাহিনী নিয়ে উত্তেজিত জনতাকে সতর্ক না করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। ৫০ টি রাইফেল থেকে ১০ মিনিট ব্যাপি ১৬০০ রাউন্ড গুলি চালানো হয়।
ভয়াবহতা→ এই হত্যাকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা ৩৭৯ জন এবং আহতের সংখ্যা ছিল ১২০০ জন। সরকারী হিসেবে মৃতের সংখ্যা ১০০০ ছাড়িয়ে যায়। এবং শিশু,নারী,পুরুষ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় এই হত্যাকাণ্ডে।
হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া বা গুরুত্ব→
হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রতিবাদে ব্রিটিশ শাসনে প্রকৃত রূপটি প্রকাশ হয়। দেশে-বিদেশে সর্বত্র ব্রিটিশ সরকারের নগ্ন রূপ প্রকাশ পায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাইট উপাধি ত্যাগ করেন। গান্ধীজী সহ জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব বৃন্দ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন।
উপসংহার→ জালিয়ান ওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড কেবলমাত্র ভারতে না সমগ্র বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। এমনকি ব্রিটিশ সরকারও এই হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বলেছেন "জালিয়ান ওয়ালাবাগের ঘটনার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেও আর কখনো ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না এই ঘটনা খুবই অস্বাভাবিক ও পাশবিক"।